আশিস গুপ্ত:
অপারেশন সিঁদুর এর পর দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক পরিস্থিতি এক অদ্ভুত বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করছে, যা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মুখোশ খুলে দিচ্ছে। ভারত দাবি করেছিল, এই অভিযান ছিল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক কড়া পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক বার্তা। কিন্তু এই অভিযানের ঠিক পরেই পাকিস্তান যে অভাবনীয় কূটনৈতিক ও আর্থিক সাফল্য অর্জন করেছে, তা শুধু ভারতের কৌশলের ব্যর্থতাই নয়, বরং তার কূটনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব প্রকাশ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে নেতৃত্ব লাভ করেছে। তালিবান নিষেধাজ্ঞা কমিটির সভাপতির আসন এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কমিটির সহ-সভাপতির পদ—এই দুটি ভূমিকাই পাকিস্তানকে এমন এক মর্যাদায় বসিয়েছে, যা তার অতীত ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। যেই রাষ্ট্র বহু বছর ধরে তালিবান, লস্কর-ই-তৈয়বা, ও জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে পড়েছে, সেই রাষ্ট্রই এখন সন্ত্রাসবিরোধী ও নিষেধাজ্ঞা নির্ধারণী কমিটির নেতৃত্বে—এ এক বিস্ময়কর উলটপালট।
এখানেই থেমে যায়নি বিষয়টি। অপারেশন সিঁদুর পরপরই পাকিস্তান বড় পরিমাণে বৈদেশিক অর্থ সহায়তা পেতে শুরু করে। ৯ মে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) পাকিস্তানকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। বিশ্বব্যাংক অপারেশনের কিছুদিনের মধ্যেই ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প সহায়তার ঘোষণা দেয়। সর্বশেষ ৩ জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB) পাকিস্তানকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে। এই বিপুল অর্থ সাহায্য এমন সময়ে এসেছে যখন পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। এর অর্থ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহল পাকিস্তানকে শাস্তি নয়, বরং পুনর্গঠন ও পুনর্নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে।
এই পটভূমিতে ভারত যা করেছে, তা কেবল হতাশাজনক নয়, অপচয়মূলকও। বলা হয়েছে, ভারত ৫৭ জন সাংসদের একটি বিশাল দল বিদেশে পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক সমর্থন সংগ্রহ এবং অবস্থান জোরালো করতে। কিন্তু এর ফল কী হয়েছে? কোনও কূটনৈতিক পদ ভারত অর্জন করতে পারেনি। কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা ভারতের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়নি। এমনকি কোনও বড় অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি বা বিনিয়োগের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা ভারত পায়নি। এই সাংসদ সফর কেবল করদাতাদের অর্থে বিলাসী ঘোরাফেরায় পরিণত হয়েছে, যার বিনিময়ে দেশের জন্য বাস্তব কিছু আসেনি।
এই পুরো চিত্রটি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির গভীর সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তান তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে নিজের অবস্থান মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে ভারত আত্মতুষ্টিতে ভোগা এক সামরিক অভিলাষের খেলা খেলছে, যার কূটনৈতিক পরিণতি আজ শূন্য। শুধু অপারেশন চালিয়ে বা শক্ত বিবৃতি দিয়ে বিশ্বমঞ্চে প্রভাব বিস্তার করা যায় না। তার জন্য দরকার বাস্তবভিত্তিক কৌশল, নিরবিচারে নয়, বরং বহুমাত্রিক কূটনীতির পথচলা।
এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দেয় যে ভারতের উচিত অবিলম্বে নিজের কূটনৈতিক কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করা। যদি তা না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতেও পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মহলে বৈধতা ও সহানুভূতি পাবে, আর ভারত একা গর্জন করেই সন্তুষ্ট থাকবে—ফলবিহীন ও রাজনৈতিকভাবে নিঃস্ব।